মোহাম্মদ জামিল খান॥
বিজ্ঞান লেখক-ব্লগার অভিজিতের হত্যাকারীদের তথ্য দিয়েছিলেন তার স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার এক বন্ধু। বন্যার ওই বন্ধু হত্যাকারীদের তাদের চলাচলের বিভিন্ন তথ্য দিয়েছিলেন। গোয়েন্দা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, অভিজিতের ভক্ত হিসেবে পরিচয় দিয়ে খুনিরা বন্যার ওই বন্ধুকে ফোন করে তথ্য চাইত। এই বন্ধুর কাছ থেকেই হত্যাকারীরা জানতে পারে অভিজিৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় একুশের বইমেলায় দুটি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে আসবেন। অভিজিৎ ও বন্যা কোথায় কোথায় যেতে পারেন, তাও জেনেছিল খুনিরা। এর ভিত্তিতে খুনিরা সংশ্লিষ্ট এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে এবং হত্যার পর নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা বের করে। খুনিরা অভিজিতের অবস্থান করা বাসার কাছাকাছি বাসা ভাড়া নিতে চেয়েছিল। তবে মামলার তদন্তের স্বার্থে ওই বন্ধুর নাম প্রকাশ করেননি ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও বায়ো-মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত অভিজিৎ রায় নিজের দুটো বই প্রকাশ উপলক্ষে ১৬ ফেব্রুয়ারি স্ত্রী বন্যাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন।
গোয়েন্দা সংস্থার বরাত অনুযায়ী, আসার পর থেকেই খুনিচক্র তাদের সারাক্ষণ ছায়ার মতো অনুসরণ করত। এসময় তারা অভিজিতকে হামলার পরিকল্পনা করে এবং সুবিধাজনক পরিস্থিতি খুঁজতে থাকে।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, 'অভিজিতের ঘনিষ্ঠদের মোবাইল কলের বিস্তারিত পর্যালোচনা করে আমরা এসব তথ্য জানতে পেরেছি।'
এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দুর্বৃত্তরা অভিজিৎকে কুপিয়ে আহত করে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আহত হন সঙ্গে থাকা স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই।
জানা গেছে, অভিজিৎ দেশে আসার পর বন্যার চাচা আবুল হোসেনের ইন্দিরা রোডের বাসায় থাকতেন। হত্যার দিন পর্যন্ত অভিজিৎ প্রতিদিন বই মেলায় গেছেন। গোয়েন্দারা মনে করছেন, বন্যার বন্ধুর কাছ থেকে খুনিরা সম্ভাব্য সবধরনের তথ্য পেয়ে সব সময় অনুসরণ করত এবং সব কর্মকাণ্ড লিপিবদ্ধ করে রাখত।
গোয়েন্দাদের ধারণা, নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেল নাস্তিকদের হত্যা করাকে ঈমানি দায়িত্ব হিসেবে জ্ঞান করেই মুক্তমত প্রকাশকারী ব্লগারদের ওপর হামলা করছে। অভিজিতের ওপর হামলার পর আনসার বাংলা-৭ নামের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এ হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। সম্প্রতি 'উপমহাদেশের আল-কায়েদা' নামে আরেকটি সংগঠন অভিজিতসহ অপর তিন ব্লগারকে হত্যার দায় স্বীকার করে।
ঘটনার তিনদিন পর ২ মার্চ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ইন্ধনদাতা হিসেবে হিযবুত তাহরীরের নেতা শাফিউর রহমান ফারাবীকে গ্রেফতার করে র্যাব। নিজের ফেসবুক পেজে অভিজিতের পারিবারিক ছবি ও যুক্তরাষ্ট্রের ঠিকানা প্রকাশ করে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়ায় ফারাবীকে এ হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে সনাক্ত করে র্যাব। পরে তাকে অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তাকে রিমান্ডে নিয়ে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা।
মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলের গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, হত্যাকারীদের সম্পর্কে সম্ভাব্য সব তথ্য তারা পেয়েছেন। তিনি বলেন,'আমরা তাদের অবস্থান চিহ্নিত করে গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।'
এর আগে গোয়েন্দারা বলেছিলেন আনসারুল্লাহ'র নেতা রেদওয়ানুল আজাদ রানা হামলার বিষয়টি সমন্বয় করেছিলেন। গোয়েন্দারা রানাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করে এবং তার ছবি ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে পাঠানো হয়। তবে এখন গোয়েন্দাদের ধারণা, রানা দেশ ছেড়ে পালিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে।
গোয়েন্দারা জানান, হামলার দিন বই মেলায় মোড়ক উন্মোচনের পর প্রায় ৮টার দিকে রানা একটি কোড মেসেজ পান যাতে বলা হয়েছে অভিজিত ও বন্যা মেলা থেকে চলে যাচ্ছেন। রানা ওই মেসেজটি স্লিপার সেলের আরও দুজনের কাছে পাঠান। যারা টিএসসিতে অভিজিত দম্পতির ওপর হামলা চালায়। হামলার পর মিশন সম্পূর্ণ হয়েছে জানিয়ে পাঠানো একটি মেসেজও আসে রানার ফোনে। এছাড়া ঢাবি এলাকার সিসিটিভির ফুটেজেও দেখা গেছে চার থেকে পাঁচজন লোক হামলার আগে অভিজিত ও বন্যাকে অনুসরণ করছিল।
গোয়েন্দাদের ধারণা মতে, রানা আনসারুল্লাহ'র অপারেশন শাখার প্রধান। আরেক ব্লগার আহমেদ রাজিব হায়দার হত্যার চার্জশিটভুক্ত আসামিও রানা। পুলিশ আনসারুল্লাহ'র আব্দুল্লাহ ও আবু নয়ন নামে আরও দুই নেতাকে খুঁজছে।
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ডিবির সাব ইন্সপেক্টর ফজলুর রহমান জানান, খুনিরা স্লিপার সেলের সদস্য এবং নিজেদের মধ্যে কোড করা মেসেজ আদান-প্রদানের কারণে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছে না।
অভিজিত হত্যার পর আরেক ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর ১২মে সিলেটে মুক্তমনা ব্লগের লেখক অনন্ত বিজয় দাসকে হত্যা করা হয়।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে ছিলেন অভিজিৎ। রাফিদা আহমেদ লেখালেখি করেন বন্যা আহমেদ নামে। অভিজিৎ 'মুক্তমনা' ব্লগের সম্পাদক ও লেখক। বুয়েটে শিক্ষকতার মাধ্যমে পেশাজীবন শুরু করার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। 'কুসংস্কার ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে' কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৭ সালে জাহানারা ইমাম পদক পায় মুক্তমনা। আর এসব মতামত প্রকাশ করায় অভিজিতের ওপর ক্ষিপ্ত হয় মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো। তাকে একাধিকবার মৌলবাদীরা হত্যার হুমকি দিয়েছিল।
/এএ/টিএন/
No comments:
Post a Comment