ধর্ষণ বাড়ছে, প্রতি ঘণ্টায় নির্যাতিত হচ্ছে এক নারী
- সারাদেশের আদালতে ঝুলে আছে দেড় লক্ষাধিক মামলা
দিনরাত ধারাবাহিকভাবে একই স্টাইলে এ জাতীয় যৌন সন্ত্রাসের ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক নেমে এসেছে কর্মজীবী নারী-শিশু ও ছাত্রী-শিক্ষিকা ও গৃহবধূদের মাঝে। শুধু যে রাতের আঁধারে নির্জন রাস্তায় নারীর সম্ভ্রমই লুট করা হচ্ছে- তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো মুক্তচিন্তার নিরাপদ পরিবেশেও উচ্চ শিক্ষার্থী নারীও নিরাপদবোধ করতে পারছেন না। আকস্মিক এ ধরনের যৌন সন্ত্রাসের দৌরাত্ম্যে সর্বত্র উদ্বেগ নেমে এলেও পুলিশ হাঁটছে সেই পুরনো পথেই। সেই চিরাচরিত ভাষায় পুলিশ বলছে, এসব বিছিন্ন ঘটনা। মাঝে মাঝে এ জাতীয় অপরাধ একত্রে ঘটে বলে মনে হয়- হঠাৎ বেড়ে গেছে। অবশ্য পুলিশের এ বিশ্লেষণকে দায় এড়ানোর কৌশল উল্লেখ করে অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন- এ জাতীয় অপরাধ আগেও ঘটত। এখন তার কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকাশও পাচ্ছে ব্যাপক হারে। এজন্য দায়ী অনেকগুলো ফ্যাক্টর। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না করায় ঘৃণিত এই সহিংসতা প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিরোধ না করা গেলে সামনের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাঙালীর প্রাণের উৎসব বর্ষবরণে গিয়ে লাঞ্ছনার শিকার হন নারীরা। গত ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখের সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে ভিড়ের মধ্যে এক দল যুবক নারীদের ওপর চড়াও হয়। সে সময় চার নিপীড়ককে ধরে পুলিশের কাছে দেয়া হলেও পরে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। সারা দেশে তোলপাড় হওয়া ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২১ মে বৃহস্পতিবার রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় গণধর্ষণের শিকার হন আদিবাসী এক তরুণী। এর পরদিন শুক্রবার যাত্রাবাড়ীতে এক তরুণীকে বাসায় আটকে রেখে নির্যাতন করে দুর্বৃত্তরা। ২৩ মে রাতে খিলগাঁও থেকে চলন্ত ট্রাকের মধ্যে স্বামীকে জুস খাইয়ে অজ্ঞানের পর স্ত্রীকে ধর্ষণ শেষে গাজীপুরের রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়। ২৪ মে সন্ধ্যায় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে জুতাপেটা করে বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র নামধারী কিছু দুর্বৃত্ত। একই রাতে মাদারীপুরের শিবচরের বন্দরখোলা গ্রামে ভাসুরের নেতৃত্বে গণধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। ২৬ মে ইবনে সিনা হাসপাতালে যৌন হয়রানির শিকার হন এক নার্স। এটি শুধু মে মাসের পাঁচ দিনের চিত্র।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দফতরের অপরাধ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত চার বছরে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৬৭ হাজার ২২৯টি। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ১২ হাজার ৯৭১ জন। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে রাজধানীসহ দেশব্যাপী ধর্ষণ ও যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে ২১১টি। তার মধ্যে শুধু ধর্ষণই ঘটেছে ১৫৯টি। বাকিগুলো ধর্ষণের চেষ্টা, হামলা, আটকে নির্যাতন ও লাঞ্ছিত করা। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনাসহ মোট ২ হাজার ৭৯ জন নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৪৯২টি আর গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৯ জন। শুধু তাই নয়, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৬ জন নারীকে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৬৩ জনকে। কিন্তু এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। কারণ, গণমাধ্যমে এসব ঘটনার বেশির ভাগই প্রকাশ পায় না। মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য মতে, গত জুন মাসে মোট ৫৬৪ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৮টি। এর মধ্যে হত্যা করেছে ৬ জনকে। এছাড়াও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ৩৮টি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জুলাইয়ে ৩৬৮ নারী বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এর মধ্যে ১৫টি গণধর্ষণসহ ধর্ষণের ঘটনা ৮৩টি। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে নয়জনকে। এ সময় ধর্ষণের চেষ্টা ও শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন ২০ জন। বেসরকারী সংস্থা 'উইম্যান ফর উইম্যান' এর এক গবেষণায় বলা হয়, নারীকর্মীরা কর্মক্ষেত্রে সাধারণ হয়রানি ছাড়াও যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এতে আরও বলা হয়, শতকরা ২৬ জন গার্মেন্টস কর্মী, ৩৫ জন গৃহকর্মী, ২ জন দিনমজুর, ১৫ জন কর্মজীবী নারী ধর্ষণের শিকার হন।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের এক রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে প্রতিঘণ্টায় একজন করে নারী নির্যাতনের শিকার হয়। এ নিয়ে দেশে তেমন প্রতিবাদ হয় না। আওয়াজ একবারেই হচ্ছে না তা নয়। সংশ্লিষ্টদের মতে, ঘরে-বাইরে সব জায়গায়ই নারীরা নিরাপত্তাহীন। নিরাপদ নয় স্বামী, শিক্ষক, বন্ধু। বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন গত ২৫ জুন জাতীয় সংসদে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সাধারণ আলোচনায় সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, দেশ এখন ধর্ষণের রঙ্গমঞ্চ। সারা দেশেই ধর্ষণ বেড়ে গেছে। নারীরা নিরাপদে চলাফেরা করতে না পারলে সভ্য দেশ বলে গণ্য করা যাবে না।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালে সারা দেশে ৪ হাজার ৬৪২টি ধর্ষণ মামলা হয়েছে। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৫৩৮টি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে সারা দেশে ৭৯৭টি ধর্ষণ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ তথ্য অনুসারে, দেশে প্রতিমাসে গড়ে ৩০০টি ধর্ষণের মামলা দায়ের হচ্ছে। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশের আদালতগুলোতে ঝুলে আছে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের দেড় লক্ষাধিক মামলা। বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ মামলা আর সাজা পাচ্ছে হাজারে সাড়ে ৪ জন আসামি। প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত ১০ বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ১১৭টি। এর মধ্যে রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২১টির, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। মামলার অনুপাতে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ শতাংশ, সাজার হার দশমিক ৪৫ শতাংশ।
বর্তমানে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। এক বছর বয়সী শিশু থেকে বিভিন্ন বয়সের শিশুরা এ বর্বরতার শিকার হচ্ছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ৮০ জনের বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৮ বছর। যা ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ৩৫ শতাংশ। আর চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই (জানুয়ারি থেকে জুন) ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৮০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ২৯ শতাংশ। ২৬২টি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাসমূহের জাতীয় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই (জানুয়ারি থেকে জুন) ২৮০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। ৮০ জন শিশুর বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছর। যা ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ২৯ শতাংশ। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ৫৯ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা মোট সংখ্যার ২১ শতাংশ, এক থেকে ৬ বছরের ৩০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা মোট সংখ্যার ১১ শতাংশ। ১১১ জন শিশুর বয়স নির্ধারণ করা যায়নি। যার হার ৩৯ শতাংশ। আর ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ২২৭ জন শিশু। এর মধ্যে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ৮০। যা ধর্ষণের শিকার মোট শিশুর ৩৫ শতাংশ। ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ৭০ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা মোট সংখ্যার ৩১ শতাংশ, এক থেকে ৬ বছরের ৫৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। যা মোট সংখ্যার ২৫ শতাংশ। ২১ জন শিশুর বয়স নির্ধারণ করা যায়নি। যার হার ৯ শতাংশ
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে না বলেই নারী ও শিশু লাঞ্ছনার ঘটনা বেড়ে চলেছে। বিচারহীনতা ধর্ষণকারীদের উৎসাহিত করছে। গত ১৩ আগস্ট ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের শাস্তি হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) এ্যাকাউন্টিং এ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের শিক্ষক মোঃ সাখাওয়াত হোসেনকে সহযোগী অধ্যাপক থেকে অবনমন করে সহকারী অধ্যাপক করা হয়েছে। এছাড়া পরবর্তী দুই বছর পদোন্নতির ব্যাপারে তিনি কোন আবেদন করতে পারবেন না। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তিনি বাধ্যতামূলক ছুটিতে থাকবেন। এটি নিঃসন্দেহে ভাল উদ্যোগ দাবি করে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে দেশের নারী ও শিশু কর্মক্ষেত্র-শিক্ষাক্ষেত্র, নিজগৃহ কোথাও নিরাপদ নয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি নারীর নিরাপত্তা বিধান করতে না পারে, তবে সেটার জবাবদিহি করতে হবে। সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বলে প্রমাণ করতে চাইলে অনতিবিলম্বে ধর্ষণে জড়িতদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোললে সেখান থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। তাদের মতে, ধর্ষণ আগেও ছিল এখনও রয়েছে। তবে মিডিয়ার বিকাশের কারণে এখন তা বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। একমাত্র সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। এ লক্ষ্যে তারা নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার সুপারিশ করেছেন বিশিষ্ট জনেরা।
Pl see my blogs;
Feel free -- and I request you -- to forward this newsletter to your lists and friends!
No comments:
Post a Comment