বাংলা ব্লগ
১৭২৯
পথিক গুহ
অসুস্থ হয়ে শ্রীনিবাস রামানুজন কেমব্রিজের হাসপাতালে। তাঁকে দেখতে এসেছেন গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডি। তিনি উদ্বিগ্ন রামানুজনের শারীরিক অবস্থায়। তামিল ব্রাহ্মণ রামানুজন কট্টর নিরামিষাশী। মাছ-মাংস থেকে দূরে। এদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে প্রোটিন-সমৃদ্ধ নিরামিষ খাবার বাজারে কম। অন্য কিছু উপসর্গের পাশে রামানুজনের শারীরিক অবনতির মূলে অপুষ্টি। আরোগ্যের জন্য তাঁকে পাঠানো হয়েছে হাসপাতালে। কেমন আছেন তিনি? জানতে হার্ডি এসেছেন সেখানে।
দেখা হতে ওঁদের কথোপকথন গণিতের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। অনেকেই জানেন সেই সংলাপ। তবু আর একবার সেই প্রসঙ্গ।
হাসপাতালের ঘরে ঢুকে হার্ডি দেখলেন রামানুজন বিছানায়। হার্ডির বন্ধু চার্লস পারসি স্নো-র বর্ণনায় জানা যাচ্ছে, তার শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ। হার্ডি রামানুজনকে বললেন, তিনি যে ট্যাক্সিতে চড়ে হাসপাতালে পৌঁছেছেন তার নম্বর ১৭২৯। হার্ডির মতে, এটা এলেবেলে সংখ্যা।
হার্ডির মন্তব্যে তাঁকে চিনতে সুবিধা হয়। তিনি নাম্বার থিওরিস্ট। গবেষণা করেন সংখ্যা নিয়ে। মুগ্ধ তাদের মহিমায়। গণিতজ্ঞের কাজ কী? এ প্রশ্নের চমৎকার জবাব হার্ডি দিয়েছেন তাঁর বিখ্যাত রচনা 'আ ম্যাথমেটিশিয়ান'স অ্যাপলজি'-তে। বলেছেন, গণিতজ্ঞ, কবি কিংবা চিত্রশিল্পীর মতো, তৈরি করেন নকশা। তবে তফাত এই যে গণিতজ্ঞের তৈরি নকশা ওদের নকশার চেয়ে বেশি স্থায়ী। কবি নকশা বানান শব্দে। চিত্রশিল্পী আঁকায় বা রঙে। আর গণিতজ্ঞ? তিনি নকশা বানান চিন্তা দিয়ে। কবি বা চিত্রশিল্পীর সৃষ্টির কেন্দ্রে কি চিন্তা থাকে না? থাকে। কিন্তু, সে চিন্তার চরিত্র আলাদা। সে চিন্তা গণিতের চিন্তার মতো নির্ভুল বা চিরস্থায়ী নয়। কবিতা বা ছবির সঙ্গে গণিতের পার্থক্যের মূল কারণ, হার্ডির মতে, গণিতের সত্য ব্যক্তি নিরপেক্ষ। কোনও কবিতা একজনের কাছে যতটা ভাল, আর একজনের কাছে ততটা উঁচু মানের না-ও মনে হতে পারে। ছবিও তাই। কিন্তু গণিতের সত্য সকলের কাছে সমান গ্রহণযোগ্য। ব্যাপারটা বোঝাতে হার্ডি টেনেছেন মৌলিক সংখ্যার উদাহরণ। মৌলিক হল সেই সব সংখ্যা, যারা দুই বা ততোধিক সংখ্যার গুণফল হয়। যেমন, ২, ৩, ৫, ৭, ১১...। কিন্তু ৬ (২x৩) বা ৩০ (২x৩ x৫) মৌলিক নয়। হার্ডি মন্তব্য করেছেন, '৩১৭ সংখ্যাটি মৌলিক, এ কারণে নয় যে আমরা ওরকম মনে করি, এ জন্যও নয় যে আমাদের মন বিশেষ একভাবে চিন্তায় অভ্যস্ত; বরং এ জন্য যে সংখ্যাটি মৌলিকই, এ জন্য যে গণিতের সত্য ওভাবেই তৈরি।'
এহেন মানুষ যে ট্যাক্সি চড়তে গিয়ে তার নম্বর নিয়েও ভাববেন, তা আশ্চর্যের নয়। যে গণিতজ্ঞের গবেষণা সংখ্যা বিষয়ে, এটা তার স্বভাবসিদ্ধ কাল। কিন্তু, ১৭২৯ একটা এলেবেলে সংখ্যা বলে হার্ডির দাবি শুধরে অসুস্থ রামানুজন যা বললেন, তার জন্য ওঁদের সংলাপ অমরত্ব লাভ করেছে। রামানুজন বললেন, 'না হার্ডি, ওটা মোটেই এলেবেলে সংখ্যা নয়। ওটা হল সবচেয়ে ছোট সংখ্যা, যাকে দু'জোড়া ঘন সংখ্যার সমষ্টি হিসেবে দু'ভাবে লেখা যায়।'
মানে? কী বললেন রামানুজন? যা বললেন, তা হল এই –
১৭২৯ = ১০৩ + ৯৩
কারণ ১০ x ১০ x ১০ = ১০০০
৯ x ৯ x ৯ = ৭২৯
১০০০ + ৭২৯ = ১৭২৯
আবার –
১৭২৯ = ১২৩+ ১৩
কারণ, ১২ x ১২ x ১২ = ১৭২৮
১ x ১ x ১ = ১
১৭২৮ + ১ = ১৭২৯
অর্থাৎ, ১০, ৯ এবং ১২, ১ – এই দু'জোড়া সংখ্যার ঘনের সমষ্টি হল ১৭২৯। এর চেয়ে ছোট আরও কোনও সংখ্যা এরকম দু'জোড়া ঘনের সমষ্টি নয়। সুতরাং, ১৭২৯ একটা বিশেষ সংখ্যা। তা মোটেই এলেবেলে নয়।
হার্ডি-রামানুজনের অমর সংলাপটি কবে প্রথম ছাপার অক্ষরে পড়েছি, আজ তা মনে নেই। বোধহয় চার দশক আগে কোনও একসময়। তখন থেকেই দু'টো প্রশ্ন জেগেছে মনে।
প্রথম প্রশ্ন : ১৭২৯ যদি ওরকম সবচেয়ে ছোট সংখ্যা হয়, তা হলে ঠিক তার চেয়ে বড় আর কোন সংখ্যা ওরকম দু'জোড়া ঘনের সমষ্টি? বা তার চেয়ে বড় আরও কোন সংখ্যা? এই ব্লগের কোনও পাঠক সংখ্যাগুলো জানালে চিরকৃতজ্ঞ থাকব।
দ্বিতীয় প্রশ্ন : আচ্ছা, ১৭২৯ সংখ্যাটির ওই বিশেষত্ব কি রামানুজন আগে জানতেন? নাকি হার্ডি বলামাত্র সেদিন তিনি তা আবিষ্কার করলেন? কোনও পাঠক এ ব্যাপারেও আলোকপাত করলে খুশি হব।
প্রশ্ন ছেড়ে মূল প্রসঙ্গে ফিরি। আগে জানা কিংবা তাৎক্ষণিক আবিষ্কার, যা-ই হোক না কেন, দু'জন জগদ্বিখ্যাত সংখ্যার কারবারির মধ্যে কেবল একজনেরই নজরে পড়েছিল ১৭২৯ সংখ্যাটির ওই বিশেষত্ব। আসলে, দেখা জিনিসটা বড় ব্যাপার। গণিত – অথবা সামগ্রিকভাবে বিজ্ঞানে – মূল কৃতিত্ব লুকিয়ে আছে ওই 'দেখা'-র মধ্যে। বিজ্ঞানের মূল কাজ নিয়ম, নকশা বা সম্পর্ক আবিষ্কার। আইজাক নিউটন বিজ্ঞানী, কারণ তিনি প্রথম দেখেছিলেন, আপেলের গাছ থেকে মাটিতে পড়া, আর চাঁদের পৃথিবীর চারদিকে ঘোরা, আসলে একই কাজ।
দেখার বিশেষ ক্ষমতার কথা বললে আর একজন বিশ্ববিখ্যাত গণিতজ্ঞের নাম মনে পড়ে। কার্ল ফ্রিডরিখ গাউস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই জার্মান পণ্ডিত গণিতের বহু শাখায় এমন উঁচু দরের গবেষণা করেছিলেন যে তাঁকে বলা হয় 'প্রিন্স অফ ম্যাথমেটিক্স'। তিনি ভবিষ্যৎ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন শৈশবেই। তাঁর জীবনের বহু ঘটনা কিংবদন্তি। একটি এ আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। বলা যাক।
গাউস তখন ক্লাস থ্রি-র ছাত্র। একদিন ক্লাসে ঢুকে গণিতের শিক্ষক সবাইকে কষতে দিলেন একটা অঙ্ক। যোগফল নির্ণয়ের। ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত পরপর সংখ্যার সমষ্টি কত? অন্য সব ছাত্র যখন ১ + ২ + ৩ +৪ + ৫... এভাবে এগোতে ব্যস্ত, তখন গাউস সেই যোগফল বের করে ফেললেন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। কী ভাবে?
শিশু গাউস দেখলেন সমস্যাটাকে অন্যভাবে দেখা যায়।
কেননা –
১ + ১০০ = ১০১
২ + ৯৯ = ১০১
৩ + ৯৮ = ১০১
...
...
৪৮ + ৫৩ = ১০১
৪৯ + ৫২ = ১০১
৫০ + ৫১ = ১০১
অর্থাৎ, অঙ্কটা আসলে ৫০টা ১০১-এর সমষ্টি। তা হলে স্যর যে যোগফল নির্ণয় করতে বলেছেন, তার উত্তর ১০১ x ৫০ বা ৫,০৫০। ব্যস।
দেখার মধ্যে তা হলে লুকিয়ে আছে সমস্যা সমাধানের ক্লু।
এই দেখা ব্যাপারটা কেমন, তা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন এ-কালের গণিতজ্ঞ ওয়াইলস। গণিতের একটা ধাঁধা, যার সমাধান মেলেনি সাড়ে তিনশো বছর, তা সল্ভ করে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ওই অধ্যাপক। ধাঁধাটার নাম 'ফার্মা'স লাস্ট থিওরেস' (এফ এল টি)। কারণ, ১৬৩০-এর দশকে ফরাসি গণিতজ্ঞ পিয়ের দ্য ফার্মা ওই ধাঁধা তৈরি করেছিলেন। ধাঁধাটি আসলে এক অঙ্ক, যা করে দেখাতে হবে। অঙ্কটি কী?
ফার্মা বলেছিলেন, তিনটে করে এমন অনেক সংখ্যা (যেমন ৩, ৪, ৫; ৬, ৮, ১০; ৫, ১২, ১৩; ১০, ২৪, ২৬ ইত্যাদি) পাওয়া যায়, যেগুলোর প্রথম দুটোর বর্গের সমষ্টি তৃতীয়টার বর্গের সমান।
৩২ + ৪২ = ৯ + ১৬ = ২৫ = ৫২
৬২ + ৮২ = ৩৬ + ৬৪ = ১০০ =১০২
৫২ + ১২২ = ২৫ + ১৪৪ = ১৬৯ =১৩২
১০২ + ২৪২ = ১০০ + ৫৭৬ = ৬৭৬= ২৬২
ফার্মা দাবি করেছিলেন, বর্গের বদলে ঘাত ৩, ৪, ৫ বা যে কোনও সংখ্যা হলেই আর ওরকম তিনটে সংখ্যা মিলবে না। তিনি তো দাবি করেই খালাস। কিন্তু, সত্যিই যে মিলবে না, তার প্রমাণ কই? সাড়ে তিনশো বছরে কেউ বা তা জোগাতে পারল না। চেষ্টা করতে গিয়ে যদিও খুলল গণিতের নানা দিক, তবু মিলল না সেই। অবশেষে ১৯৯৫ সালে সফল হলেন ওয়াইলস।
প্রমাণের লক্ষ্যে সাড়ে তিনশো বছরের যাত্রা কেমন? উত্তরে ওয়াইলস টেনেছেন চমৎকার উপমা। বলেছেন, অন্ধকার হলঘরে চলাফেরা যেমন, তেমনই ছিল ওই প্রচেষ্টা। প্রথমে হাতড়ে বেড়ানো। এখানে-সেখানে ঠোক্কর। তার পর একসময় হঠাৎই ইলেকট্রিক সুইচে হাত। আলো জ্বালতেই সব জটিলতা এক মুহূর্তে উধাও। তখন সব কিছু পরিষ্কার।
অর্থাৎ, সেই দেখা।
দেখেন কি কেবল বিজ্ঞানী?
নাহ্, তা নয়।
কবি বা সাহিত্যিক, যাদের কাজ সন্ধান নয়, সৃষ্টি, তারাও বিশেষ দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন বলেই সৃষ্টি করতে পারে। আমজনতার তেমন দেখার চোখ নেই বলে সবাই কবি-সাহিত্যিক নয়।
মনে পড়ছে ছোটবেলায় পড়া প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'যাচ্ছি পূজায়' কবিতাখানি। বিষয় কলকাতায় ফ্ল্যাটবাড়ির দুই ভাড়াটের পূজার ছুটিতে বেড়ানোর পরিকল্পনা। একজন নিসর্গ শোভার সন্ধানে নামী জায়গায় যেতে উদ্গ্রীব। অন্যজনের গন্তব্য তার দেশগাঁয়ের বাড়ি। কেন? তার উত্তর : 'সব কিছু তার অন্য রকম, মানুষ মাটি জল।' সে আবার কেমন কথা! দেশের বাড়ির মানুষ মাটি জল অন্যরকম হয় নাকি? এবার তার উত্তর : 'সে তো চোখ দিয়ে যে দেখতে জানে, তার কাছে কেবল।'
বালক সত্যজিৎ রায়-কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন, তাও ওই 'চোখ দিয়ে দেখা' বিষয়ে। আমাদের অতি পরিচিত সেই কবিতা–
বহুদিন ধরে' বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্ব্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।।
No comments:
Post a Comment